আগুণের পরশমণি পরিবারের যুদ্ধের Representation
চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হলো কোন বিষয়কে ঘিরে একটি পরিষ্কার চিত্র দাড় করানো! ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Representation’। একটি সিনেমাতে এই Representation যত নিখুঁত হবে, দর্শক তত বেশি চলচ্চিত্রে মনোযোগী হতে পারবে। Representation এর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, চলচ্চিত্রের ছোট ছোট বিষয়ের মধ্য দিয়ে আপনি অনেক বড় বড় বার্তা দর্শককে দিতে পারেন।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ নির্মিত ‘আগুণের পরশমণি’ Representation theory’র সফল একটি উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি গর্বের ইতিহাস, ঠিক তেমনি দুঃখের দলিল। এই দুঃখের মাঝে কি মানুষ বেঁচে থাকা ছেড়ে দিয়েছিলো? প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে হুমায়ুন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ বেছে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু বড় কোন পরিসরে না গিয়ে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাধ্যমে পুরো যুদ্ধের Representation করাটা সেই সময়ের জন্য একেবারেই নতুন আর উদ্ভাবনী চিন্তা ছিলো।
‘আগুণের পরশমণি’ চলচ্চিত্রে পরিচালক দেখিয়েছেন ‘৭১ এর ঢাকা, ঢাকার পরিবেশ, স্বাধীন বাংলা বেতার এর ধ্বনি, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি, আরও কত কি! কিন্তু চলচ্চিত্রের মূল বিষয় ছিলো একটি পরিবারের মাধ্যমে পুরো বাংগালী সমাজের উপস্থাপন। সে সময়কার মানুষ অফিসে কি করে যেতেন, বাচ্চা-কাচ্চাদের কেমন কাটতো ঘরের ভেতর বন্দী জীবন, দেয়ালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ছবি টাঙ্গিয়ে রাখাটাই কেন ছিলো গুরুত্বপূর্ণ! চলচ্চিত্রে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা!
প্রথমেই উল্লেখ করেছি পরিচালক বড় কোন পরিসরে না গিয়ে শুধুমাত্র একটি পরিবারের প্রতিদিনকার জীবন দিয়ে পুরো যুদ্ধকে চিত্রিত করেছেন। সেটা ঘরের ভেতর মেয়েদের আটকে থাকাটা হতে পারে, স্বাধীন বাংলা বেতার বা চরমপত্র শোনা হতে পারে, খোলা ছাদে উঠতে না দেওয়াটা হতে পারে, এমনকি ঘরের টিয়াপাখিগুলোকে যুদ্ধ শেষ হলেই উড়িয়ে দিতে চাওয়াটাও স্বাধীনতাকামী মানুষদের আকাঙ্খাকে বর্ণনা করে।
যুদ্ধ থামাতে পারেনি তখনকার মানুষের রোজকার জীবন, কিন্তু সময় কোথাও যেন আটকে আছে। যুদ্ধ শেষ হলেই সময় আবার চলা শুরু করবে, চলচ্চিত্রে দেয়াল ঘড়ির বন্ধ রাখাটা যেন যুদ্ধে সময় আটকে থাকাকেই নির্দেশ করে। মানুষের কথোপকথনের মাধ্যমেও মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক অবস্থান পরিচালক তুলে ধরেন। যুদ্ধ নিয়ে বাংগালীদের মনেই যে একটা দ্বি-পাক্ষিক দ্বন্দ্ব ছিলো সেটাও একটি দৃশ্যে তুলে ধরা হয়।
পরিচালক হুমায়ন আহমেদ আমাদের দেখিয়ে দেন, মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে অপ্রিয় সত্যকে, যার নাম মৃত্যু। হুমায়ুন আহমেদ মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রটির দ্বারা দেশের স্বাধীনতার Representation করেছেন, মুক্তিযোদ্ধার যখন গুলি লাগে, পুরো পরিবারের মধ্যে নেমে আসে দুঃখের কালো ছায়া। যেন এখনি তারা যুদ্ধে হেরে গিয়েছে বা হারার পথে চলে এসেছে। মা বলেন ভোর হলেই সে তাকে (মুক্তিযোদ্ধা) ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, কিন্তু ভোর হবে কি না সেই আশ্বাস মুক্তিযোদ্ধাটি পায়না। বাবা বলেন ভোর অবশ্যই হবে, ঘরের দুই মেয়েও নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ দিয়ে আশায় বুক বাঁধে ভোর আসবেই। কিন্ত ভোর কি আসলেই আসে? ছবির ঠিক শেষে আমরা দেখতে পাই যে ভোর হয়, কিন্তু আমরা স্বাধীনতা পাই কি পাই না, সেই উত্তরটা ঠিক জানা যায় না।
সে সময়কার মানুষ আসলেও জানতো না যে ভোর একদিন আসলেই আসবে কি না, বিজয়ের দেখা তারা পাবে কিনা, খোলা ছাদে তারা উঠতে পারবে কি না, মনের কথা প্রকাশ করতে পারবে কি না! তখন এই স্বাধীনতা পাওয়ার আকাঙ্খা যে কতটা অনিশ্চিত ছিলো, সেটি বোঝানোর জন্যই হয়ত পরিচালক ব্যাপারটি উত্তরহীনভাবেই রেখে দেন।
আগুনের পরশমণিতে হুমায়ূন আহমেদ বেশ কিছু মেটাফোর বা রূপকের ব্যবহার করেছেন। পুরো চলচ্চিত্রে রূপকের ব্যবহার লক্ষণীয়। সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর একজন করে প্রতিনিধি পেয়েছি আমরা চলচ্চিত্রে । চরিত্রগুলো তাদের ভিন্ন পেশা, শিক্ষা, জ্ঞান, অর্থনৈতিক অবস্থা, বয়সের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। এখানেই আগুনের পরশমণি ব্যতিক্রম। মতিন সাহেব একদিকে যেমন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিচ্ছেন, আবার ঘরে জিন্নাহর ছবিও টাঙাচ্ছেন। এক মধ্যবিত্ত পিতার চিরায়ত এই ভীতসন্ত্রস্ত অসহায়ত্বের রূপটিও আমাদের চেনা।
সুরমার চরিত্রের মাঝে আমরা নিজের মায়ের ছায়াই খুঁজে পাই। আমরা খুঁজে পাই অভিমানী এক তরুণী রাত্রিকে। মুক্তি পাবার তীব্র বাসনা যার মনে, একই সাথে যুদ্ধে যাবার আকুতিও তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে। আছে অপালা, আছে বিন্তি। যুদ্ধ নিয়ে যারা খুব একটা চিন্তিত নয়। সব শেষে আসে বদি। যে স্পষ্টতই তরুণ সমাজেরপ্রতীক।
চলচ্চিত্রে চরিত্রগুলো, বিশেষ করে নারী চরিত্রগুলো ঘরে বন্দী। তাদের এই বন্দী দশাকে পরিচালক প্রকাশ করেছেন জানালার শিককে জেলের গরাদের মতো করে দেখিয়ে। দুই নারী চরিত্র সুরমা আর অপালার প্রথম দৃশ্যটিই এমন। আবার রাত্রি যখন তার বাবার কাছে ছাদে যাবার অনুমতি চায়, সে তখন জানালার ওপাশ থেকে সত্যিকারের কয়েদীদের মতো করেই লোহার শিক ধরে রেখেছিলো। চরিত্রের সাথে জেলের সিম্বোলজির এমন ব্যবহারের সবচে বিখ্যাত উদাহরণ হলো বিলি ওয়াইল্ডারের “Double Indemnity”। সেখানে চরিত্রের বন্দীত্ব বোঝাতে ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডসের ছায়া জেলের শিকের মতো করে পড়ে।
রাতের দৃশ্যগুলোতে হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রগুলোর ছায়া বড় করে দেখাতে চেয়েছিলেন। এগুলো হলো তাদের মনের ভয়ের প্রতীক। তিনি এই পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। হুমায়ূন আহমেদ তার চলচ্চিত্র বানানোর গল্প বইয়ে নিজেই স্বীকার করেছেন, সবাই তার অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়েছে। বেশ কয়েকটি দৃশ্যে দেখা যায়, পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য করে থুথু নিক্ষেপ করা হচ্ছে। দোকানদার আর ভিক্ষুকের থুথু নিক্ষেপ গোপন হলেও, তুহিনেরটা সরাসরি পাকিস্তানী অফিসারের মুখে গিয়ে পড়ে । মতিন সাহেবের অফিস যাওয়ার পথের দৃশ্যে দেখা যায়, দুইজন বাংলাদেশীকে উলঙ্গ অবস্থায় কান ধরে উঠবস করাচ্ছে। পরবর্তী ফ্রেমে আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, একটি মৃত কুকুরের পাশে দুটো মানুষের মৃতদেহ পড়ে আছে। বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানীরা শুধু উলঙ্গ করেই ছাড়েনি, কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে।
আরও কয়েকটি লক্ষণীয় প্রতীক হলো: লাল-সবুজ রঙের টিয়া পাখির খাঁচায় বন্দী অবস্থার ক্লোজ শট, জিন্নাহর ছবির উপরে মতিন সাহেব (বাংলাদেশীর) রক্তের দাগ লেগে যাওয়া, মুক্তিযোদ্ধা বদির শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্ত চেটে খাচ্ছে একটি কুকুর। ছবিতে শান্তি কমিটির প্রধান হিসেবে এক ব্যক্তিকে দেখানো হয়। এমনকি সেই ব্যক্তির অ্যাপিয়ারেন্সের সাথে বাংলাদেশের চিহ্নিত এক যুদ্ধাপরাধীর মিলটা হয়ত সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত।
‘আগুণের পরশমণি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হুমায়ুন আহমেদ Representation theory’র একটি বিস্তারিত ধারণা দর্শকদের দেন, যেটি সেসময়কার সকল শ্রেনীর দর্শক বুঝতে না পারলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি মুহুর্ত তখন বাংগালী সমাজের জন্য কতটা দুর্বিসহ ছিলো, কত রকম অনুভূতির রাঙতায় মোড়ানো ছিলো আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ; সেটি ঠিকই ধারণা করতে পারে। তখনকার প্রত্যেকটি মানুষের ভেতর স্বাধীনতার ডামাডোল কি রূপে বাজতো সেই কথাগুলোই পুরো চলচ্চিত্র ব্যাখ্যা করে। আমরা সবাই আমাদের জীবনে কোন না কোন জিনিসের আকাঙ্ক্ষা করে থাকি, সেই সময়ে প্রত্যেকটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিলো একটিই, স্বাধীনতা। হুমায়ুন আহমেদ সেই গোটা জাতির আকাঙ্খাকে কিভাবে চলচ্চিত্রে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন সেটির ধারণা পেতে চাইলে আমাদের সবারই আগুণের পরশমণি সিনেমাটি দেখা উচিত।
শিক্ষক হোক কিংবা লেখক, নাট্যকার, গীতিকার, অথবা পরিচালক যে পরিচয়ই বেছে নিয়েছেন, প্রতিবারই স্বীয় ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার বুঝি গোপন কোনো পরশমণি ছিলো। যার স্পর্শে গতানুগতিকতার ভীড়ে ঠিক বেরিয়ে পড়তো নিখাদ স্বর্ণ। এ মণির সন্ধান আর কেউ জানে না। এটা ছিলো তার নিজস্ব পরশমণি- হুমায়ূনের পরশমণি। যার অনন্য নিদর্শন আগুনের পরশমণি।